
রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া সহিংসতার এই ঘটনা শুধু একটি দরবার বা কবরকে কেন্দ্র করে সীমাবদ্ধ ছিল না—এটি যেন গোটা সমাজের ধর্মীয় উত্তেজনা, সহিষ্ণুতার অভাব এবং গুজবনির্ভর উগ্র মনোভাবের এক বিস্ফোরণ।
জুমার নামাজ শেষে গোয়ালন্দের জুড়ান মোল্লাপাড়া এলাকায় যখন অন্যান্য দিনের মতো স্বাভাবিক কর্মযজ্ঞ চলছিল, ঠিক তখনই কয়েক হাজার ধর্মপ্রাণ মানুষ জড়ো হয়ে পড়ে সেই দরবার শরিফে, যেখানে আশির দশক থেকে নুরুল হক ওরফে নুরাল পাগলা নিজেকে ‘ইমাম মাহদি’ দাবি করে আসছিলেন। বহু বছর আগে মৃত্যুবরণ করলেও, তাঁর অনুসারীদের বিশ্বাস ও দরবারের কর্মকাণ্ড নিয়ে সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে প্রচুর বিতর্ক সৃষ্টি হয়। সেই উত্তেজনা রূপ নেয় সহিংস উন্মাদনায়।
জনতা প্রথমে দরবারে ঢুকে ভাঙচুর শুরু করে, এরপর দরবারে আগুন ধরিয়ে দেয়। কিন্তু সবচেয়ে বিভীষিকাময় ও অমানবিক ঘটনা ঘটে এরপর—তারা কবর খুঁড়ে তুলে আনে মৃত নুরাল পাগলার মরদেহ এবং সেটিকে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের মোড়ে নিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে পেট্রল ঢেলে আগুনে পুড়িয়ে দেয়। কবর থেকে মরদেহ তুলে পুড়িয়ে ফেলা—এই দৃশ্য যেন ২১ শতকে নয়, বরং কোনো আদিম যুগের পৈশাচিক বর্বরতার ফিরে আসা। পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছালে উত্তেজিত জনতার সঙ্গে সংঘর্ষ বেধে যায়, যাতে মো. রাসেল মোল্লা (২৮) নামের এক যুবক নিহত হন এবং আহত হন অর্ধশতাধিক মানুষ।
পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ আকার ধারণ করে যে, গোটা এলাকা সেনাবাহিনী, র্যাব ও পুলিশের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা হয় এবং সাধারণ মানুষের চলাচল সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়। সরকার এই ঘটনাকে অমানবিক ও আইনবিরোধী উগ্রতা আখ্যা দিয়ে এর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। ৩,৫০০ জন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে এবং ভিডিও ফুটেজ দেখে শনাক্ত করে গ্রেপ্তারের প্রক্রিয়া চলছে।
তবে প্রশ্ন রয়ে যাচ্ছে—এত বড় একটা ঘটনা কি শুধু একজন বিতর্কিত ধর্মগুরুর অনুসারীদের দরবার ভাঙা বা কবর তুলে মরদেহ পুড়িয়ে ফেলার মধ্যে সীমাবদ্ধ? নাকি এটি সমাজে জমে ওঠা দীর্ঘদিনের অসহিষ্ণুতা, ধর্মীয় বিভ্রান্তি এবং নেতৃত্বের ব্যর্থতার একটি ভয়াবহ বহিঃপ্রকাশ? গোয়ালন্দ এখন শুধু শোকাহত নয়, আতঙ্কগ্রস্ত এক জনপদ—যেখানে মানুষ ধর্ম ও আইন, বিশ্বাস ও সহিংসতা, ন্যায় ও প্রতিশোধ—এই চরম দুই মেরুর মাঝে দাঁড়িয়ে নিজেদের অবস্থান খুঁজে ফিরছে।
প্রতিবেদনঃ শফিকুর রহমান